History of Embroidery

by Nafisa

History of Embroidery

সূচিশিল্প (Embroidery) ঐতিহাসিক বিকাশ
সূচিশিল্প বা Embroidery একটি প্রাচীন শিল্পকলা, যা বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের উপর সুতা, মুক্তা, পাথর কিংবা অন্য উপকরণ দিয়ে অলংকরণ করার কৌশল। এই শিল্পের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের পুরোনো এবং এটি বিভিন্ন সভ্যতার বিকাশের সাথে জড়িয়ে আছে।
প্রাচীন যুগ: সূচিশিল্পের প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় প্রাচীন মিশর, চীন ও মেসোপটেমিয়ার সভ্যতায়। চীনে প্রায় ৫ম সহস্রাব্দ আগে সূচিশিল্পের ব্যবহার দেখা যায়। মিশরের ফারাওদের আমলে রাজকীয় পোশাকে সূচিকর্মের উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসময়ে সূক্ষ্ম সুতা ও সোনালি-রুপালি তার ব্যবহার করে অলংকৃত পোশাক তৈরি হতো।
মধ্যযুগ: মধ্যযুগে ইউরোপে সূচিশিল্প বিশেষ মর্যাদা পায়। চার্চের জন্য তৈরি ধর্মীয় পোশাক ও ব্যানারে সূচিকর্ম ব্যবহার হতো। একই সময়ে ইসলামি বিশ্বেও সূচিকর্মের বিস্তার ঘটে, বিশেষ করে পারস্য ও মুঘল সাম্রাজ্যে। এখানকার সূচিশিল্পে জটিল নকশা, ফুল ও জ্যামিতিক মোটিফের প্রাধান্য ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে সূচিকর্ম ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী; বিশেষত মুঘল যুগে জর্দৌসি, চীকন, কাঞ্চনকাম, আরি ও কাঁথাশিল্পের প্রচলন ব্যাপক হয়।
উপমহাদেশে সূচিশিল্প: ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সূচিকর্ম আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য পেয়েছে। বাংলায় সূচিশিল্প বিশেষ রূপে বিকশিত হয়, যেমন কাঁথাশিল্প। পুরানো শাড়ি বা কাপড় টুকরো টুকরো করে স্তরে স্তরে সেলাই করে নতুন নকশা সৃষ্টি করা হতো। কাঁথায় প্রাকৃতিক দৃশ্য, পাখি, পশুপাখি, ফুল এবং ধর্মীয় চিত্র ফুটিয়ে তোলা হতো। এটি ছিল মূলত নারীদের সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ।
আধুনিক যুগ: উনিশ ও বিশ শতকে শিল্পবিপ্লবের পর মেশিনে সূচিকর্মের প্রচলন হয়, যার ফলে সূচিশিল্প বাণিজ্যিক শিল্পে পরিণত হয়। তবে হাতে সূচিকর্মের কদর কমেনি; বরং এটি বিশেষ রুচির পরিচয় হিসেবে আজও বহন করছে। আধুনিক বাংলায়, বিশেষ করে বাংলাদেশের নকশীকাঁথা, জামদানি কাঁথা এবং বিভিন্ন হাতে কাজ করা পোশাক বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশের সূচিশিল্পের ইতিহাস
সূচিশিল্প শুধু পোশাকের অলংকরণ নয়; এটি একটি সংস্কৃতির বাহক। প্রতিটি অঞ্চলের সূচিকর্ম তার নিজস্ব ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং জীবনযাত্রার গল্প বহন করে। বাংলাদেশের সূচিশিল্পের ইতিহাস প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে, যা বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষ করে “কাঁথাশিল্প” বাংলাদেশের সূচিকর্মের এক অনন্য ঐতিহ্য বহন করে।
সূচনা ও প্রাচীন বিকাশ: বাংলার গ্রামীণ সমাজে কাঁথাশিল্পের উৎপত্তি হাজার বছরের পুরনো। মূলত গৃহিণীরা পুরনো কাপড়, বিশেষ করে পুরনো শাড়ি ও ধুতি ব্যবহার করে স্তরে স্তরে সেলাই করে নানান রকম নকশা ফুটিয়ে তুলতেন। এই প্রক্রিয়াকে বলা হতো কাঁথা তৈরির কাজ। এটি ছিল একদিকে পুনর্ব্যবহারের কৌশল, অন্যদিকে নারীদের শিল্পকলা ও আবেগের প্রকাশ।
প্রাচীন বাংলায় সূচিশিল্প ছিল সাধারণত গৃহস্থালি জীবনকেন্দ্রিক। বালিশের কাভার, বিছানার চাদর, শিশুদের পোষাক, এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ কাপড়েও সূচিকর্ম করা হতো। সূচিকর্মের মোটিফ বা নকশায় দেখা যেত ধর্মীয় প্রতীক, দৈনন্দিন জীবনের চিত্র, ফুল, পাখি, মাছ, গ্রামীণ দৃশ্য ইত্যাদি।
মধ্যযুগ: মুঘল প্রভাব: ১৬শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর মুঘল শাসনামলে বাংলার সূচিশিল্পে নতুন মাত্রা যোগ হয়। মুঘলদের জৌলুশপূর্ণ জীবনধারার ছোঁয়ায় সূচিকর্মের মধ্যে আসে আরও বেশি জটিলতা ও সৌন্দর্য। জর্দৌসি (সোনালি ও রুপালি সুতা দিয়ে সূচিকর্ম), কাঞ্চনকাম (চুমকি-সুতার কাজ) এবং আরি কাজের মতো সূক্ষ্ম কলাকৌশল বাংলায় জনপ্রিয় হয়।
ঔপনিবেশিক যুগ ও পরিবর্তন: ১৮শ ও ১৯শ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসনের সময় সূচিশিল্প কিছুটা ব্যবসায়িক রূপ নিতে শুরু করে। ইউরোপীয়দের কাছে বাংলার সূচিশিল্প বিশেষত নকশিকাঁথা অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু একইসাথে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশনের ফলে হাতে সূচিকর্মের স্থান কিছুটা কমে যায় এবং মেশিনের তৈরি কাপড় ছড়িয়ে পড়ে।
নকশীকাঁথার উত্থান: নকশীকাঁথা বাংলাদেশের সূচিশিল্পের সবচেয়ে পরিচিত ও মর্যাদাপূর্ণ রূপ। নকশীকাঁথা শুধু একটি ব্যবহারিক সামগ্রী নয়, এটি নারীদের সৃজনশীলতার, গল্প বলার এবং আবেগের এক অনুপম মাধ্যম। প্রতিটি নকশীকাঁথা একটি গল্প বলে — যেমন প্রেমের কাহিনি, গ্রাম্য জীবন, ধর্মীয় বিশ্বাস, স্বপ্ন ও আশা।
বিশেষ করে জামালপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী অঞ্চলের নকশীকাঁথা তাদের অনন্য নকশা ও সূক্ষ্ম কারুকার্যের জন্য বিখ্যাত।
আধুনিক বাংলাদেশে সূচিশিল্প: আজকের বাংলাদেশে সূচিশিল্প শিল্পকলা ও ব্যবসা উভয়ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বহু সংস্থা ও এনজিও গ্রামীণ নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নকশীকাঁথা, আরি কাজ, ক্রোশিয়া, সুই-সুতা কাজের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের সূচিশিল্প, বিশেষ করে নকশীকাঁথা, জামদানি এম্ব্রয়ডারি এবং আরি কাজের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে।